Sustain Humanity


Saturday, August 15, 2015

বাংলাদেশের পরিচয় সঙ্কট ও ‘আরবীকরণ’অবলোকন মাসুম খলিলী

উপসম্পাদকীয়
বাংলাদেশের পরিচয় সঙ্কট ও ‘আরবীকরণ’অবলোকন
মাসুম খলিলী
১৪ আগস্ট ২০১৫,শুক্রবার, ০০:০০Naya Diganta

 
 

বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় পরিচয় কী হবেÑ বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। এ পরিচয়ের সূত্র ধরে কখনো বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ, আবার কখনো বিভক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন যখন গড়ে ওঠে, তখন বাংলাদেশভুক্ত ভূখণ্ডের মানুষের আত্মপরিচয়ের মুখ্য উপাদান হয়ে ওঠে ভাষার পরিচয় তথা বাঙালিত্ব। অথচ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় একই ভূখণ্ডের মানুষের মুখ্য পরিচয় হয়ে উঠেছিল ধর্মবিশ্বাস। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আত্মপরিচয়ের এ সঙ্কট একেক সময় একেকভাবে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হয়েছে। 
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরপরই বাঙালিত্ব অর্থাৎ ভাষার পরিচয়কে একক হিসেবে বিবেচনায় এনে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের প্রচেষ্টা চলে। অবশ্য সে সময় ধর্মবিশ্বাসের পরিচয়কে মুছে দেয়ার জন্য কারো কারো প্রচেষ্টাকে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব প্রশ্রয় দেননি। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন নবরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারার সাথে মিলিয়ে দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এ ধারাকে স্বতন্ত্র ধর্মীয় শিক্ষার ধারা হিসেবে বজায় রাখেন। ইসলামি সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণে বাধাদানকে তিনি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপরও তিনি বাঙালি পরিচয়কে জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে মুখ্য ধরে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদেরও বাঙালি হয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর জাতীয় পরিচিতি বা জাতিসত্তার পরিচয়ের বিষয়টি নতুনভাবে গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশভুক্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, বাঙালিদের পাশাপাশি পাহাড়ি ও অন্যান্য ুদ্র জনগোষ্ঠীর অভিন্ন পরিচয় ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ পরিচয়ে মুখ্যভাবে বিবেচনায় আনা হয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসের বিষয়টিকে। এরপর ভাষা, ধর্মবিশ্বাস ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশী পরিচয়ের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী ও বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি পার্থক্য রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। 
জাতীয় পরিচয়ের এ ধারা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বিভিন্ন সময় উঠলেও বাংলাদেশী নাগরিক বা জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধানের চরিত্রগত বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পরও এ দেশের জনগণের নাগরিক পরিচয় ‘বাংলাদেশী’ রেখে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতিসত্তার পরিচয় শুধু কৃষ্টিগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ, এমনটি নয়। এর সাথে যেমন বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি সম্পর্ক রয়েছে জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়টিরও। জাতিগতভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য একটি ভূখণ্ডের রাষ্ট্রিক বাস্তবতার রূপপ্রাপ্তির অপরিহার্য উপাদান। যেসব ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল, সে অঞ্চলের অভিন্ন বন্ধন তৈরির মূল উপাদান ছিল ধর্ম বা বিশ্বাসগত পরিচয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতের নেতারা ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ও অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেছিলেন। সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ রচনায় ধর্ম পরিচয়কে তারা একটি উপাদান হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একক উপাদান হিসেবে নয়। এ কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা রাষ্ট্র গঠনের সময় প্রধান মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।
বর্তমানে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট সরকার ভারতের সে পরিচয়ে নতুন একটি আচ্ছাদন দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিজেপির তাত্ত্বিকেরা বলছেন, ‘সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ অর্থ বুঝতে হবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এই হিন্দুত্বকে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের কর্তারা ভারতীয়ত্বের সাথে একাকার করে বোঝাতে চাইছেন। তারা বলছেন, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়, এটি হলো ভারতীয় হওয়ার এমন এক অনস্বীকার্য অবয়ব, যার মধ্যে থেকে অন্য কিছু হতে হবে। অর্থাৎ ভারতের কাউকে মুসলিম হতে হলে তাকে হতে হবে হিন্দু মুসলিম, খ্রিষ্টানকে হিন্দু খ্রিষ্টান, বৌদ্ধকে হিন্দু বৌদ্ধ। ভারতীয় জাতীয় পর্যায়ে নতুন এই পরিচয়-দর্শনকে গ্রহণীয় করা জটিল হবে বলেই মনে হয়। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে দেশটিতে।
বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় নির্ণয় এবং ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বিতর্ক এখনো রয়েছে। নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইছেন কেউ কেউ। প্রবাসী বাংলাদেশী অধ্যাপক তাজ হাশমী (তাজুল ইসলাম হাশমী) বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরবির ব্যবহার তুলে ধরে এ দেশ ও দেশের সমাজকে আরবীকরণ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন (Arabisation of Bangladesh, Daily Star, ১৪ জুলাই ২০১৫)। তার মতে, তুর্কি, আফগান ও ইরানি শাসক, বণিক ও সুফিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে। এখানে স্থানীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে ইসলামের বাহকদের কৃষ্টি-বিশ্বাস ও রীতিনীতির সমন্বয়ে একধরনের মিশ্র বা সমন্বয়মূলক (syncretistic) ধর্মচর্চার রূপ নিয়েছে। এ কারণে হিন্দুদের ‘সত্য নারায়ণ’র অনুকরণে মুসলিম সমাজে ‘সত্য পীর’র আবির্ভাব দেখা যায়। ইসলামের সেই সমন্বয়ের রূপকে পরিবর্তন করে এখানে আরবি ওয়াহাবি-সালাফি ধারা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আরব বিশ্বে কর্মরত প্রবাসীদের প্রভাব এবং আরব শাসকদের তুষ্ট করার প্রচেষ্টা রয়েছে এর পেছনে সক্রিয়। এর অংশ হিসেবে ইসলামের বিভিন্ন ইবাদতের ফারসি প্রতিশব্দগুলোও পাল্টে দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তিনি সালাত-নামাজ, রাসূল-পয়গম্বর, আল্লাহ হাফেজ-খোদা হাফেজ প্রভৃতি উদাহরণের উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের অনেক মেয়ে এখন যে হিজাব বা বোরখা পরছেন তাকে বলেছেন লেবাননের খ্রিষ্টান যাজিকাদের পোশাক হিসেবে। তার দাবি, বাংলাদেশের নারীদের এক সময় এ পোশাকের সাথে কোনো পরিচয় ছিল না। তিনি অবশ্য এটাও বলতে পারতেন যে, মাথায় ওড়না দেয়া মুসলিম মেয়েদের দেখতে মাতা মেরির মতো মনে হয়। শুধু একটি নয়, আরো অনেক ক্ষেত্রে আসমানি কিতাবের অনুসারী মুসলিম, খ্রিষ্টান বা ইহুদিদের মধ্যে মিল পাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। 
তাজ হাশমী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি আরবিতে লেখাকে খুবই আপত্তির সাথে দেখেছেন। বলেছেন, আরবি লেখা দেখে মনে হবে বাংলাদেশে চর্চিত প্রধান ভাষার মধ্যে এটিও রয়েছে। মুসলিম নাম রাখার প্রসঙ্গটিও তিনি এ প্রসঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তার মূল আপত্তি দুই জায়গায়Ñ প্রথমত, অতীতের ফারায়েজি, সংস্কার ও দেওবন্দি ইত্যাদি আন্দোলনে যেভাবে বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চার নামে এখানে প্রচলিত সমন্বয় রূপের ইসলাম চর্চাকে প্রতিস্থাপিত করার প্রচেষ্টা চলেছিল, তার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আরবির যে চর্চা হচ্ছে, সেটি এখানকার কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে পাল্টে দিচ্ছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।’
তাজ হাশমী ভারতে জন্ম, বাংলাদেশে পড়াশোনা আর পাশ্চাত্যে অধ্যাপনা। তিনি ইতিহাসের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে অবহিত ব্যক্তি। প্রত্যেক নবী-রাসূল আ: যে সমাজে এসেছেন, সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে তারা ধারণ করেছেন। শুধু সেটুকুতেই পরিবর্তন করেছেন, যা আল্লাহর একত্ববাদ ও রেসালাতের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতিতে বেড়ে উঠেছেন। নবুওয়াতপ্রাপ্ত হওয়ার পর তৌহিদ ও রেসালাতের সাথে সাংঘর্ষিক ধর্মীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তিনি পরিবর্তন এনেছেন। সেখানে একজন আরবের জীবন-জীবিকা ও আচরণের সাথে ইসলাম সমন্বিত হয়ে তিনি মুসলিম আরব হয়েছেন। রাসূল সা:-এর সাহাবি ও ইসলামের পরবর্তী প্রচারকারীরা আরব থেকে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেন। তারা ইসলামের মৌলিক বিষয় তৌহিদ ও রেসালাত তথা ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। ইসলামের এসব বাহক যে সমাজে গেছেন, সেখানকার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের ওই অংশটুকুতেই পরিবর্তন এনেছেন; যাতে ইসলামের মূলনীতিগুলোর বৈপরীত্য রয়েছে। যেমনÑ আরব থেকে বাংলায় আসা ধর্ম প্রচারক হজরত শাহজালাল, শাহ মাখদুম, শাহ আমানতসহ যেসব সুফি এখানে ধর্ম প্রচার করেছেন; তারা তৌহিদ, রেসালাত ও অন্যান্য মৌলিক বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা এখানকার খাদ্যরীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, কৃষি, ক্ষেতখামার ইত্যাদিতে পরিবর্তন আনেননি, তবে পাল্টে দিয়েছেন মূর্তিপূজা ও একত্ববাদবিরোধী ভাবধারা। এ পরিবর্তনটি তাদের মধ্যেই করেছেন, যারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যারা হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য কোনো ধর্ম চর্চা করেন, তাদের উপাসনালয় তারা বিধ্বস্ত করতে যাননি। 
তবে সময়ের আবর্তনে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে অনেক সময় বিকৃতি অনুপ্রবেশ করে মূল বিষয়গুলোর চর্চা অন্য রূপ নেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এসব প্রবণতা সৃষ্টির পেছনে ঔপনিবেশিক শাসন শক্তি যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনিভাবে সমাজের কায়েমি শক্তির সক্রিয়তাও এর পেছনে ছিল। এসব করা হয়েছে মূলত সমন্বয়ের যুক্তি দেখিয়ে। স¤্রাট আকবরের দ্বীন ই এলাহি এ ধরনের একটি সমন্বয়ের ধর্ম। উপমহাদেশে মোজাদ্দেদ আল ফেসানি, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলভি, হাজী শরীয়তুল্লাহ অথবা দেওবন্দি আলেমরা যে সংস্কার আন্দোলন বিভিন্ন সময় করেছেন, সেটি ইসলামের বিকৃত চর্চাকে বিশুদ্ধ রূপদানের প্রচেষ্টার অংশ ছিল। এ প্রচেষ্টায় শিরক ও বেদাতকে বর্জনের প্রচেষ্টা ছিল, কিন্তু ভাষা বা দৈনন্দিন জীবনাচরণ বাদ দিয়ে আরবি বা আরব সংস্কৃতি গ্রহণের কোনো আহ্বান তাদের ছিল না।
পবিত্র কুরআন মক্কায় জন্মগ্রহণকারী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ওপর আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার কারণে কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে ও মানতে হলে আরবি ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও শিখতে হবে। নামাজের দোয়াদরুদ, সূরা ইত্যাদি আরবি ভাষায়। ফলে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সমাজে আরবি ভাষার বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে এই বিস্তৃতি কোনো অঞ্চলেই স্থানীয় ভাষাকে প্রতিস্থাপিত করেনি। অনেক স্থানে সালাত, সাওম, আল্লাহ-রাসূলÑ এসবও স্থানীয় ভাষায় পরিবর্তিত হয়েছে, যার উল্লেখ তাজ হাশমী করেছেন। এভাবে সালাত-নামাজ, সাওম-রোজা, রাসূল-পয়গম্বর বা আল্লাহ হাফেজকে ‘খোদা হাফেজ’ বলার মধ্যে বড় রকমের ব্যত্যয় কিছু ঘটেনি। কিন্তু এক্ষেত্রেও অন্তর্নিহিত অর্থগত পরিবর্তন ঘটতে পারে, এমন শব্দকে গ্রহণ করা হয়নি। যেমন সালাতের অর্থ হিসেবে নামাজকে গ্রহণ করা হয়েছে, পূজা বা উপাসনাকে গ্রহণ করা হয়নি। আবার কেউ ধর্ম চর্চার এসব কিছু মূল আরবি শব্দে বললে তাতেও ইসলাম মানতে গিয়ে স্থানীয় প্রেক্ষাপট ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটবে না। 
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আরবি মানেই ইসলাম নয়। ইসলামের আবির্ভাবের আগে যেমন আরবি ভাষায় আল্লাহ নির্দেশিত পথের বিপরীত ধর্মের চর্চা হয়েছে, তেমনি এখন আরব বিশ্বের দেশে দেশে আরবি ভাষাতেই বিভিন্ন বিকৃত জীবন চর্চাও চলছে। এখনকার বিভিন্ন আরব দেশে আরবি ভাষায় বিকৃত নগ্ন ডিসকো বা বেলে নাচ ও নানা পর্নোগ্রাফির বিস্তৃতির কথা কে না জানে। সুতরাং ইসলামের ধর্মগ্রন্থ আরবি ভাষায় এলেও আরবি মানেই ইসলাম নয়। আরবিতে কারো নাম ‘আবদুল্লাহ’ রাখা হলে সেটিকে সঠিক মনে করা হবে, কিন্তু ‘আব্দুর রাসূল’কে সঠিক মনে করা যায় না। ইসলামের আবির্ভাব আরবে ও আরবি ভাষায় হওয়ার কারণে ইসলামের বিস্তৃতির সাথে আরবি চর্চা কিছুটা হবেই। সীমিত হলেও মাতৃভাষার পরেই ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আরবি চর্চা হয়ে থাকে। এ চর্চা যদি সমাজকে বিশুদ্ধ জীবনাচরণের দিকে নিয়ে যায়, তার সুফল দেশ-জাতি নির্বিশেষে সবাই পেতে বাধ্য।
বাংলাদেশের জাতিসত্তা নির্ধারণে ধর্মের প্রভাবের বিষয়টি তাজ হাশমীর লেখায় আছে। একটি রাষ্ট্র গঠনের যেসব উপাদানের অনস্বীকার্র্য ভূমিকা থাকে, তার মধ্যে ধর্ম একটি। তবে ধর্মবিশ্বাসই এককভাবে রাষ্ট্র গঠনের উপাদান নাও হতে পারে। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পেছনে অথবা আরব বিশ্বে বা ইউরোপে অনেক রাষ্ট্রের বিভক্তি এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে দেখানো যেতে পারে। তবে যে ভূখণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ, এটি ধর্মবিশ্বাসের কারণে দু’বার বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্তিতে মেলবন্ধনের অন্য বিষয়গুলো গৌণ হয়ে গিয়েছিল।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ব্রিটিশরা করেছিল মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে বিবেচনায় রেখে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় বৃহত্তর বাংলা আবার ভাগ হয়েছিল একই বিবেচনায়। ১৯৪৭ সালে যে অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তান ছিল, সেটিই আজকের বাংলাদেশ। এমনকি, যে চুক্তিবলে আজ ছিটমহল বিনিময় বা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ হচ্ছে, সেটি প্রথম স্বাক্ষরিত হয় নেহরু ও ফিরোজ নুন ভারত-পাকিস্তানের সরকারপ্রধান থাকাকালে। আজ বাংলাদেশ কেন স্বাধীন থাকবে এবং কেন পশ্চিম বাংলার সাথে মিশে যাবেÑ এ দু’টি প্রশ্ন করা হলে কী জবাব আসবে? বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সেখান থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার পক্ষে প্রধান যুক্তি হবে। আর ধর্মীয় বিশ্বাস ও মুসলিম স্বকীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির পুরো বিষয়টি বিবেচনা থেকে বাদ গেলে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিশে যাওয়া বা অখণ্ড ভারতের অংশ হওয়ার যুক্তি অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না। তাজ হাশমীর বক্তব্য এ দিক থেকে খুবই বিপজ্জনক।

No comments:

Post a Comment