রফতানীমুখী শিল্পের বিকাশ এবং রফতানী খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা এখনো বাধাগ্রস্ত
দেশের চিংড়ীসহ মৎস্যজাত পণ্য রফতানীতে প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। এমনকি প্রচলিত কিছু আইন ও নীতিমালা সংশোধন করে রফতানীর ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতেও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ- সরকারের গ্রহণ করা কোড অব কন্ডাক্ট যথাযথভাবে মেনে চলা হচ্ছে না। আর এ কারণেই চিংড়ী রফতানীর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রফতানী বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং নতুন নতুন পণ্য রফতানীকে উৎসাহিত করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে রফতানী আয়ের উপর সেই দেশের সরকার নির্দিষ্টহারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে কৃষিপণ্যসহ বেশ কিছু পণ্যের রফতানী আয়ের উপর প্রণোদনা দেয়ার বিধান রয়েছে। অর্থমন্ত্রী রফতানী খাতে প্রণোদনা (ইন্সেন্টিভ) দেয়ার বিধান সম্পর্কে মাঝে মাঝে বিরূপ মন্তব্য করে, যা আদৌ ঠিক নয়। রফতানী খাতে প্রণোদনা দেয়ার বিধান সম্পর্কে সে তার নেতিবাচক মনোভাব স্বভাবসুলভ বিরক্তির সঙ্গে প্রকাশ করে থাকে। রফতানী খাতে যে অর্থ প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হচ্ছে সেটিকে সে অপচয় বলে গণ্য করে। দেশের কষ্টার্জিত রাজস্ব আয়ের অর্থ প্রণোদনা হিসাবে বিলিয়ে দিয়ে রফতানী খাতকে টিকিয়ে রাখতে সে রাজি নয়।
ইউরোপ, আমেরিকায় মহামন্দা শুরু হওয়ার আগে তৈরি পণ্য রফতানীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যে ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতো, এখন বিশ্ববাজারে পণ্য মূল্যের প্রতিযোগিতা তার চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে। কারণ চীন, ভারত, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের সরকার পণ্য উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য রফতানী করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। রফতানী বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণে এই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পণ্য উৎপাদন এবং রফতানীর অনুকূলে। কাঁচামালের যোগান, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ, ভৌত অবকাঠামো এবং সুস্থ আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ ইত্যাদির সমন্বয়ে দেশগুলোকে সার্বিকভাবে ব্যবসাবান্ধব দেশ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। দেশের ভেতরে সব সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখার পরেও সেসব দেশের সরকার অনেক পণ্যের রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এসব দেশের সরকার জানে, রফতানী ব্যবসা ত্বরান্বিত করা গেলে রাষ্ট্রের কোষাগারে নগদ ডলার জমা হবে। রফতানী চাঙ্গা থাকলে দেশের অর্থনীতি প্রাকৃতিক নিয়মেই চাঙ্গা থাকে। এ কারণে সেসব দেশের অর্থমন্ত্রীরা রফতানী খাতে ইন্সেন্টিভ দেয়ার বিধানকে 'অপচয়' ভেবে বারবার সেই বিধানের প্রতি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয় না। দেশের ভেতরে পণ্য উৎপাদন এবং সেই পণ্য রফতানী করার ফলাফল দেশের অর্থনীতিতে কতটা সুদূরপ্রসারি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সম্পূর্ণ অসচেতন। ফলে দেশে রফতানীমুখী শিল্পের বিকাশ এবং রফতানী খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা এখনো বাধাগ্রস্ত।
বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলার 'নারায়ণগঞ্জ মডেল'কে সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী কি ব্যবসায়ীদের কাছে ভালো কিছু আশা করতে পারে? চীন এবং ভারতে পরিবহন ব্যয় স্থিতিশীল থাকার বিপরীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের ব্যয় গত তিন বছরে চারগুণ বেড়ে গেছে। ঢাকা শহরের গার্হস্থ্য ব্যবহারে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দেশের বাণিজ্যিক খাতের চিত্র ভয়াবহ। দেশের বহু এলাকায় সারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে পারে না। ফ্যাক্টরিগুলো নিজস্ব জেনারেটর চালিয়ে পণ্য উৎপাদন করে থাকে। উচ্চ মূল্যের অকটেন, পেট্রোল কিংবা ডিজেল পুড়িয়ে তারা যে পণ্য উৎপাদন করে তার দাম তুলনামূলকভাবে অনেক চড়া। চীন, ভারত, তাইওয়ানের মতো উৎপাদনবান্ধব দেশ তাদের দেশের রফতানীমুখী ফ্যাক্টরিগুলোতে চব্বিশ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মূল্যবান অকটেন কিংবা ডিজেল পুড়িয়ে পণ্য উৎপাদন করে আমাদের দেশের রফতানীকারক ব্যবসায়ীদেরকে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হচ্ছে। রফতানীকারকেরা সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা বাবদ যৎসামান্য যা পায় সেটা পেট্রোল ডিজেলের দাম মেটাতে ফুরিয়ে যায়। বাজেট প্রণয়নের সময় সরকারের অর্থমন্ত্রী মাঠ পর্যায়ের প্রতিকূলতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমরা আশাবাদী।
রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনা দিতে গিয়ে টুকটাক যা অনিয়ম ঘটে থাকে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নজরদারি অক্ষুণœ রেখে দূর করা সম্ভব। রফতানীকারীর হিসাবে রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনার দাবি ব্যাংকে দাখিল করার পরে অর্থ ছাড় করার আগেই ব্যাংক সেই দাবির যথার্থতা সঠিকভাবে যাচাই করলে এই ক্ষেত্রে কোনো প্রকার অনিয়ম ঘটার সম্ভাবনা থাকা সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য, রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। প্রণোদনার দাবিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে পারলে এটি নিয়ে অনিয়ম ঘটার সম্ভাবনা প্রায় খুবই কম। কারণ নির্দিষ্ট কনসাইনমেন্ট বিদেশী ক্রেতার ঘরে পৌঁছানোর পরে পণ্যের মূল্য বাবদ ডলার কিংবা পাউন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রত্যাবাসিত হতে হবে এবং প্রত্যাবাসিত বৈদেশিক আয়ের বিপরীতে যথারীতি প্রণোদনা ছাড় করা হবে। এই পরিস্থিতিতে গুরুতর অনিয়ম করার দুরভিসন্ধি নিয়ে কোনো প্রতারক, নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অসৎ কোনো চক্র হাত না মেলালে প্রণোদনার অপব্যবহার সম্ভব নয়।
আগামী বাজেটে রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে রফতানীকারক ব্যবসায়ীরা আশাবাদী। রফতানীকারক ব্যবসায়ীরা যে ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে পণ্য উৎপাদন এবং পণ্য রফতানী করে থাকে। অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রণয়নের সময় সেটি আন্তরিকভাবে অনুধাবন করবে এবং বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটবে বলে ব্যবসায়ীরা আশাবাদী। রফতানীর বিপরীতে প্রণোদনা খাতে বিগত অর্থবছরের তুলনায় ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হলে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরো বাড়বে এই বাস্তবতা বাজেট প্রণয়ন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ আন্তরিকভাবে অনুধাবন করবে এবং সেই আলোকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে বলেও আশাবাদী।
তবে এক্ষেত্রে যে কিছু অসঙ্গতি ও অনিয়মের উদাহারণ হবে না তা নয়। উদাহারণত বলতে হয়- টেলিফোনিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে রফতানী আয়ের বিপরীতে বস্ত্রখাতের ওভেন, নিটিং ও টেরি টাওয়েল-এর জন্য ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দিতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এ পদ্ধতিতে বিদেশে উইন্ডো অফিস খুলে একই ব্যক্তি আমদানিকারক ও রফতানীকারক সেজে ভুয়া রফতানী আদেশ দাখিল করে নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা। ভুয়া রফতানী আদেশ দাখিল করে রেমিট্যান্সকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে এনে নগদ সহায়তা নেয়ারও সুযোগ তৈরি হবে। এতে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিতে পড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত, ব্যবসায়ীদের চাপে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ত্রুটিপূর্ণ এ ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশনা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি বস্ত্রখাতের ওভেন, নিট ও টেরি টাওয়েল রফতানীর বিপরীতে ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠিয়েছে।
৫ শতাংশ নগদ সহায়তা হচ্ছে, কোনো ব্যবসায়ী বস্ত্র খাতের পণ্য রফতানী করে ১০০ ডলার দেশে আনলে ওই ১০০ ডলারের বিপরীতে সরকার তাকে ৫ ডলার সমপরিমাণ অর্থ প্রণোদনা দেবে। এর আগে এ সুবিধা পেতে রফতানীর সব ডকুমেন্টশন কালেকশনের প্রয়োজন ছিল। এখন থেকে শুধু টেলিফোনে নিশ্চিত করলেই হবে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছে, টিটি'র মাধ্যমে সম্পাদিত অগ্রিম রফতানীমূল্য প্রত্যাবাসন সংখ্যায় অনেক বেশি হয়ে থাকে। এ খাতে সরকারের নগদ সহায়তা গ্রহণের সুযোগের অপব্যবহার করতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিদেশে উইন্ডো অফিস খুলে আমদানির অর্ডার দিচ্ছে। এতে আমদানিকারক ও রফতানীকারক একই ব্যক্তি হওয়ায় ভুয়া রফতানী আদেশ দাখিল করে সরকারের নগদ সহায়তা নেয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এতে করে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এ সহায়তা পাবে না। কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর মধ্যেই জনগণের করের এই অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা হবে।
তাছাড়া যারা হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের সাথে যোগসাজসে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ভুয়া রফতানী আদেশ দাখিল করে ওই আদেশের বিপরীতে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ নেবে। এতে করে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা একদিক দিয়ে বৈধতা পাবে। অন্যদিকে তারা অবৈধভাবে জনগণের করের টাকার ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেবে। এমনিতেই খোলাবাজারে ব্যাংকের চেয়ে মার্কিন ডলারের দাম সবসময় ২-৩ টাকা বেশি থাকে। এর সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ যুক্ত হয়ে তা ৭-৮ টাকায় দাঁড়াবে। ফলে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমায় দেশের কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ক্রমন্বয়ে কমতে থাকবে। কাজেই এসব ক্ষেত্রে সরকারকে সক্রিয় নজরদারি ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
No comments:
Post a Comment