বর্তমান অবস্থা কি জরুরি অবস্থার চেয়ে ভালো?
বদরুদ্দীন উমর
প্রকাশ : ২৪ মে, ২০১৫
বদরুদ্দীন উমর
প্রকাশ : ২৪ মে, ২০১৫
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা বিদায় হওয়ার পর স্বাধীন ভারতে জনগণের অবস্থার দিকে তাকিয়ে ‘গণনাট্য মঞ্চের’ শিল্পীরা গান গাইতেন ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমাডুমডুম, জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম লাগল দেশে ধুম।’ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দেয়ার পর বাংলাদেশে সে রকম গণসঙ্গীত লেখা ও গাওয়া না হলেও বাংলাদেশের জনগণের যে অবস্থা প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত চলে আসছে সেটা আরও অনেক সঙ্গীন। শাসকশ্রেণীর লোকেরা ও তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা করে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কতগুলো দিনে ঢাকঢোল বাজিয়ে অনেক কথার ফোয়ারা ফোটালেও তাদের এই ‘চেতনা’ কীর্তনের কোনো হদিস বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় কোনো দিন থাকেনি। শুধু তাই নয়, এদিক দিয়ে পরিস্থিতি এখন এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া চরিত্রসম্পন্ন লোকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় উৎপাদকদের কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ১৯৭১-এর পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই থাকেনি। মানব ইতিহাসে সব দেশেই মধ্যস্বত্বভোগীরা যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তখন তার অনিবার্য আনুষঙ্গিক হিসেবে অর্থনীতিতে লুটতরাজের প্রাধান্য থেকেছে এবং সমাজে ব্যাপকভাবে চুরি, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তি, খুনখারাবি, অপহরণ ইত্যাদির আধিক্য দেখা গেছে। বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই ক্ষমতার জোরে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সমাজতন্ত্রের কথা বলে তারা দেশের সব শিল্পবাণিজ্য জাতীয়করণ করে নিজেদের লোকদের সেগুলো পরিচালনার ভার দিয়ে তাদের জন্য শর্ত সৃষ্টি করেছিল জাতীয় সম্পদ লুটপাটের। সমাজতন্ত্রে শিল্পবাণিজ্য জাতীয়করণ হলেও জাতীয়করণ ও সমাজতন্ত্র যে এক জিনিস নয়, এ নিয়ে কোনো আলোচনার প্রয়োজন এখানে নেই। ওয়াকিবহাল মহলের সবাই জানেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও শিল্পবাণিজ্য, বিশেষত শিল্পের একটা অংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। ব্রিটেন, ভারত ইত্যাদি দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রেলওয়ে থেকে নিয়ে অনেক ধরনের শিল্প এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হয়। এভাবে রাষ্ট্র শিল্প পরিচালনা করার সময় তার দায়িত্ব সমাজতন্ত্রীদের হাতে থাকে না। বুর্জোয়া পুঁজিমালিক ও তাদের প্রশাসকরাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে শিল্পবাণিজ্য জাতীয়করণের সময়েও এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব কোনো সমাজতন্ত্রীর হাতে ছিল না। উপরন্তু এর পরিচালনা ছিল মধ্যস্বত্বভোগীদের দল আওয়ামী লীগের লোকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। এভাবে ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে রাতারাতি অগাধ ধন-সম্পত্তি এবং অর্থের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিনিয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ ‘সমাজতন্ত্রের’ কথা বলে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করেছিল। এর ফলে নবঅর্জিত অর্থ-সম্পদ শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিশেষ কোনো সুযোগ না থাকায় তারা অন্যভাবে নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগ করতে শুরু করে। যেহেতু বাণিজ্যও জাতীয়করণের আওতায় ছিল সে কারণে এ বিনিয়োগ তারা শুরু করে বেআইনি অভ্যন্তরীণ ব্যবসা অর্থাৎ কালোবাজারি ও মজুদদারিতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থাৎ চোরাচালানে। তখন চোরাচালান বৃদ্ধির ওপর অনেক রিপোর্ট সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হতো। এভাবে কালোবাজারি ও মজুদদারি এবং চোরাচালানিতে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা পরিণত হয় ব্যবসায়ী শ্রেণীতে। এ বিনিয়োগকারীদের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার অল্পদিনের মধ্যেই বিনিয়োগের সিলিং এক লাফে ২৫ লাখ থেকে ৩ কোটিতে ধার্য করেছিল এবং তারপর সেটা ১৯৭৫ সালের দিকে ১০ কোটিতে উঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী-বাকশালী আমলে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে শিল্প পুঁজির কোনো উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়নি। উপরন্তু এক ধরনের ব্যবসায়ী শ্রেণী গড়ে উঠেছিল বড় আকারে। বেআইনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এভাবে গড়ে ওঠে এই ব্যবসায়ীরা শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং রাজনীতিতে পরিণত হয়েছিল জনস্বার্থের দিক থেকে এক অতি বিপজ্জনক শ্রেণীতে।
এ শ্রেণীটির নানা তৎপরতা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘উন্নতি’ শুরু হয়। কাজেই এই ‘উন্নতির’ চরিত্র যাই হোক, বাংলাদেশে ‘উন্নতি’ হয়নি এটা বলা যাবে না। এই ‘উন্নতির’ নিদর্শন রাজধানী ঢাকার উন্নতির মধ্যে দ্রুত পরিলক্ষিত হয়েছিল। চারদিকে বড় বড় অট্টালিকা এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আকাশচুম্বী অফিস ইমারত ঢাকার আকাশ রেখা (ঝশুষরহব) একেবারে পাল্টে দিয়েছিল। আজকের ঢাকায় হাজার হাজার ইমারত তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকাকে পরিণত করেছে এক মহানগরে। অন্যদিকে এসব অট্টালিকা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিশাল ভবনগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকায় গড়ে উঠেছে গরিবদের অসংখ্য বস্তি। সেখানকার বাসিন্দাদের কোনো নিয়মিত কাজ নেই, বাসগৃহের অবস্থা গরু-ছাগলের গোয়ালঘরের মতো, খাওয়ার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্য রক্ষার কোনো মানবিক ব্যবস্থা নেই। কাজেই একদিকে নব্যশাসক-শোষকদের বিলাসবহুল বাসভবন ও জৌলুসপূর্ণ জীবন এবং অন্যদিকে গরিব শ্রমজীবীদের মানবেতর জীবন দেখা যায় সমান্তরালভাবে।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মজুরির তুলনায় অনেক নিচে। অর্থাৎ শ্রমিকদের শ্রমশক্তি শোষণ এখানে হয় নির্মমভাবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটির মতো। এখন এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্য উৎপাদন, যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে শিল্প উৎপাদন। উভয় ক্ষেত্রেই মূল কৃতিত্ব হচ্ছে শ্রমজীবী কৃষক ও শ্রমিকের। তবে এখানে পার্থক্য আছে। শিল্প-কারখানা শ্রমিকদের তুলনায় গ্রামীণ মজুরদের মজুরি বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এই বৃদ্ধি কোনো কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের আন্দোলনের মাধ্যমে অথবা পুঁজিমালিকদের বদান্যতার কারণে হয়নি। এর মূল কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়া এক ধরনের বিকাশের মাধ্যমে হয়েছে, যার বিশদ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা এখানে সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, এর পেছনে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ও কৃষির বিকাশ সত্ত্বেও বলা দরকার যে, এই কৃষি শ্রমিকদের সারা বছরের কাজের কোনো সংস্থান নেই। এ বিষয়ে কোনো সরকারের কোনো চিন্তা পর্যন্ত দেখা যায়নি। এ কারণে গ্রামীণ জনগণের কর্মহীন অংশ বেশ বড় আকারে শুধু যে ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে এসে জড়ো হয়েছে তাই নয়, কাজের জন্য লাখ লাখ লোক নিয়মিতভাবেই প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। মরিয়া হয়ে তাদের একটা অংশ এ মুহূর্তে নৌকোযাত্রী (নড়ধঃসধহ) হিসেবে দেশ ছেড়ে কিভাবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লিবিয়ার উপকূলবর্তী সাগরে ভাসমান অবস্থায় এবং সেই দেশগুলোর অভ্যন্তরে কিভাবে দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়েছেন তার বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ কোটিপতির উদ্ভব হওয়া সত্ত্বেও তারা এমন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এভাবে ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছে যার ফলে দেশের লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে বেআইনি ব্যবসা, ফড়িয়াগিরি, লুটতরাজ, ঘুষ-দুর্নীতি এবং ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে তারা ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়ার কারণেই জনগণের জীবনে এ দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। এরাই হল ১৯৭১ সালের শেষে স্বাধীন বাংলায় ক্ষমতাসীন হওয়া মধ্যস্বত্বভোগীদের উত্তরাধিকারী। গরিব ও ধনীর আয় ও ধন-সম্পদের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য এখন সৃষ্টি হয়েছে, সেটা পাকিস্তান আমলে এ ধরনের পার্থক্যের থেকে অনেক বেশি। এটা হল বিগত ৪৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ‘উন্নয়নের’ একটা লক্ষণীয় দিক।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জনগণের জীবনে যে দুর্দশা সৃষ্টি হয়েছে; লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তি ইত্যাদি যেভাবে এখানে অর্থনীতি ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে এ দেশে জনগণের বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার যে জয়জয়কার হবে এটা এক অবাস্তব ও অসম্ভব চিন্তা। ১৯৭২ সাল থেকেই লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তির সঙ্গে সন্ত্রাস সরকারি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়মিত ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তৎকালে রক্ষীবাহিনী যে নির্যাতন বাংলাদেশের জনগণের ওপর করেছিল এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল তার ফলেই শেখ মুজিবুর রহমান তার গণবিরোধী একদলীয় শাসন কায়েম করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর জন্য ফ্যাসিস্ট চরিত্রসম্পন্ন চতুর্থ সংশোধনী পাস করে তিনি ১৯৭২ সালে তাদেরই প্রণীত সংবিধানকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। শেখ মুজিবের সেই সংবিধানের এই চরিত্র ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসনের উপযোগী হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলেও ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল করার প্রয়োজন তাদের হয়নি, বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পর অবশ্যম্ভাবীভাবে যা সর্বত্রই দেখা যায়। প্রয়োজনীয় সামান্য সংশোধনীর মাধ্যমে এই সামরিক শাসকরা ১৯৭২ সালের সংবিধান দিয়েই নিজেদের শাসন কাজ চালিয়েছিলেন। এই ম্যাজিক তারা শিখেছিলেন শেখ মুজিবের কাছে।
বর্তমান বাংলাদেশে যে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলবৎ রয়েছে, এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই এখানে যে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট শাসন কার্যকর থেকেছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই এ পরিস্থিতি এখন এখানে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদন নানামুখী হয়েছে, ধন-সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু যেভাবে ও যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে তাতে দেশের জনগণের মতপ্রকাশ, সমাবেশ, রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা ইত্যাদি সব ধরনের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা শাসকশ্রেণীর হামলার মুখে ধূলিসাৎ হয়েছে। আওয়ামী-বাকশালী আমলে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারবিরোধী সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেআইনি ঘোষণা করে যেভাবে সরকারি দল বাকশাল ছাড়া সব ধরনের বিরোধী দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সরকারি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাতে সেই শাসনকে ফ্যাসিস্ট ছাড়া অন্য কোনোভাবে আখ্যায়িত করার উপায় ছিল না। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী ক্ষমতাসীন হলে তার পরিণতি কী দাঁড়ায় সেটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে এই মধ্যস্বত্বভোগী ও তাদের উত্তরসূরি দস্যু চরিত্রসম্পন্ন ব্যবসায়ী শ্রেণীর শাসনের চরিত্র কী হবে সেটা ওই সময়েই নির্ধারিত হয়েছিল। এজন্যই বর্তমানে প্রাপ্ত অবস্থাকে আকস্মিক বলার উপায় নেই। শেখ হাসিনার বর্তমান শাসন ১৯৭৪-৭৫ সালে শেখ মুজিবের আওয়ামী-বাকশালী শাসনেরই অনিবার্য উত্তরাধিকার।
শেখ মুজিবুর রহমান বেপরোয়াভাবে আইন প্রণয়ন করে যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন, যেভাবে তিনি দেখিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন হয়নি, সেই একইভাবে শেখ হাসিনার সরকারের আমলেও বস্তুত তা-ই দেখা যাচ্ছে। পার্থক্য এই যে, আগে যেভাবে আইনি ঘোষণার মাধ্যমে জনগণের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল, তার পরিবর্তে এখন অঘোষিত এক চরম বেপরোয়াভাবে শেখ হাসিনা কার্যত তা-ই করছেন। জনগণের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, রাজনৈতিক তৎপরতার স্বাধীনতা- সবকিছুই এখন পুলিশের মাধ্যমে সরকার এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যা নিষিদ্ধকরণেরই শামিল। ঢাকায় এখন সভা-সমাবেশের কোনো জায়গা নেই। সব নিষিদ্ধ। প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তাসহ দুই-একটি রাস্তা এখন হল সমাবেশের স্থান! শুধু তাই নয়, জনগণের এই স্বাধীনতাও পুলিশের হাতে! বাংলাদেশে এখন পুলিশই জনগণের স্বাধীনতার মালিক!! অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধসহ পাকিস্তান আমলে জনগণের সব রকম সংগ্রাম হয়েছিল বাঙালির সরকারের বাঙালি পুলিশের হাতে জনগণের ওপর নির্যাতন করার অধিকার তুলে দেয়ার জন্য।
নির্বাচন যে বাংলাদেশে কত বড় প্রহসন ও ধাপ্পাবাজি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে তার উদাহরণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এবং বিগত এপ্রিল মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। এদেশে যে বিরোধীদলীয় নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়, এটা দেখা যাচ্ছে রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর ইত্যাদি শহরে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় মেয়রদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের অপসারণের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনসহ সবকিছুই এখন সরকারের সরাসরি হুকুমের অধীন হয়ে পড়ায় নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে উচ্ছেদ হয়ে গেছে। কোনো প্রকৃত জনপ্রতিনিধির নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশে আর নেই। এর থেকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক শাসন ক্ষেত্রে আর কী হতে পারে?
বস্তুতপক্ষে জরুরি পরিস্থিতি জারি হলে জনগণের কোনো অধিকার যেমন থাকে না, সেই একইভাবে জনগণের কোনো অধিকার আজ আর নেই। পরিস্থিতি এমনই ভয়াবহ যে এর সুযোগে রাজনৈতিক নির্যাতন ও দস্যুবৃত্তি বেপরোয়াভাবে চলছে। জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন এখন চরম পর্যায়ে। উত্তর বাংলার সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুর জমিজমা-ভিটেবাড়ির ওপর হামলা হয়ে চলেছে। উর্দুভাষীদের ওপর একইভাবে হামলা হচ্ছে। ঠিক এক বছর আগে মিরপুরের কালশীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং পুলিশের সহায়তায় দশজন উর্দুভাষীকে একটি ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল উর্দুভাষীদের কলোনি দখল করার উদ্দেশ্যে। সে বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ইত্যাদি আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যত্র ছাত্রীদের ওপর যৌন হামলা করছে, তার বিরুদ্ধেও সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। অবস্থা দেখে মনে হয়, সরকারকে সমর্থনের বিনিময়ে দুর্বৃত্তদের বাংলাদেশে অবাধ স্বাধীনতা দেয়ার এক ব্যবস্থাই এখন কার্যকর রয়েছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা এখন কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার এক উদাহরণ হল কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের এক ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেএস সেন হলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। পুলিশ সেখানে গিয়ে হলে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে সে অনুষ্ঠান বন্ধ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন শুধু মাঠে বা প্রকাশ্য কোনো জায়গায় সভা-সমিতি নিষিদ্ধ তাই নয়, চার দেয়ালের মধ্যেও সভা করা নিষিদ্ধ! এ অবস্থা চলতে থাকলে সর্বত্রই এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এটা কোনো কথার কথা নয়। এটাই হল বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার থেকে কোনো অংশেই ভালো নয়। একে এক স্বৈরতন্ত্রী শাসনের দ্বারা জারিকৃত এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই জরুরি অবস্থাই এখন বাংলাদেশে জারি আছে।
২৩.০৫.২০১৫
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
২৩.০৫.২০১৫
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments:
Post a Comment