Sustain Humanity


Tuesday, July 21, 2015

CPIM West Bengal added 7 new photos. ২১শে জুলাই ১৯৯৩। সেদিন কি ঘটেছিল......

২১শে জুলাই ১৯৯৩। সেদিন কি ঘটেছিল......
৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিলো,
৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিলো,
গুলি-বোমা-পাথরে জখম হন ২১৫পুলিশ,
ধর্মতলায় সাংবাদিক মার খেয়েছিলেন,
‘বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিল’ জানান মণীশ গুপ্ত
জ্যোতি বসুকে গাড়ি থেকে নামাতে ছদ্মবেশ সোনালিদের,
মৃতদের একজনের নাম জানে না তৃণমূল,
১জন মারা যায় ‘সিরোসিস অব লিভারে’,
বিরোধিতা করে বসুর শরণাপন্ন হন গণিখান,
জন্মের আগেই ২১শে জুলাই চরিত্র বুঝিয়েছিল তৃণমূল!
নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ১৯শে জুলাই — দলটি আসলে ‘দুষ্কৃতীদের ক্লাস্টার’। ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুব একটা নেই, যেখানে দীর্ঘ বাইশ বছর আগেই কোনও দলের চরিত্র এভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন কোনও দল কী হতে পারে, কী কী করতে পারে তা স্পষ্ট করেছিল ২১শে জুলাই-ই।
তখন ১৯৯৩। মুখ্যমন্ত্রী তখন কমরেড জ্যোতি বসু। স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মণীশ গুপ্ত। তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিই হয়নি। মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসে। তিনি তখন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী। তিনিই ডাক দিয়েছিলেন —‘মহাকরণ অভিযান’-র। ঘোষণা ছিলো ‘মহাকরণ দখল করা হবে’। যদিও কংগ্রেস এই ‘অভিযান’-র বিরোধিতা করে।
আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৩-র ২৪শে জুলাই একটি খবর প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল —‘গুন্ডামি রুখতে গণি বসুর সঙ্গে’। সংবাদে জানা যায়, তৎকালীন কংগ্রেস নেতা এ বি এ গণিখান চৌধুরী নয়াদিল্লির বঙ্গভবনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ২১শে জুলাইয়ের আগে। গণিখান চৌধুরী সেদিন পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে রক্ষা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ধরনের ব্যবস্থা নেবেন তাকে নিঃশর্তে সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী বলেন, গুন্ডামি করে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীকে ঢুকতে না দেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হতে পারে না। আপনাকে আমি নির্বাচনের মাধ্যমে গদি থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করবো। আপনিও তার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু কেউ যদি জোর করে আপনার চেয়ারটা কেড়ে নিতে চায় তা হলে সেটা হবে স্রেফ গুন্ডামি। এটা কোনভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও যে যুব কংগ্রেসের এই ধরনের বেপরোয়া ঘটনার সমালোচনা করেছেন তা জ্যোতি বসুকে গণিখান চৌধুরী জানান সেদিন।
কিন্তু তবু রক্ত ঝড়েছিল। কী হয়েছিল ২১শে জুলাই? পুলিশের গুলিতে ১৩জন যুব কংগ্রেস ‘কর্মী’ নিহত হয়েছিলেন ময়দানে। ‘২১শে জুলাই’ বলতে সোজা কথায় এমনটাই বলা হয়। কিন্তু কেন পুলিশ গুলি চালালো? যারা মারা গিয়েছিলেন, তাঁরা কারা? সেদিন মমতা ব্যানার্জি, মদন মিত্র, সোনালি গুহদের কাণ্ডকারখানা কেমন ছিলো? মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি ওই ২১শে জুলাই নিয়ে কী করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরগুলি খুঁজলেই বোঝা যায় — কী হয়েছিল ১৯৯৩-র ২১শে জুলাই।
স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে মণীশ গুপ্ত সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। সেই হলফনামা অনুসারে, ওইদিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে ‘বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো’। সেদিন ১৩ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছিলো। আশ্চর্য হলো মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু আজও তৃণমূল জানে না ওই ঘটনায় মৃত ১৩তম ব্যক্তিটি কে? তৃণমূলের ওয়েবসাইটে এখনও ওই ১৩ নম্বর জায়গার পাশে লেখা আছে —‘অ্যানোনিমাস’। অর্থাৎ অজানা। কেন তাঁর পরিচয় গোপন রাখেন মমতা ব্যানার্জি?
‘২১ শে জুলাইয়ের তদন্ত কমিশন’-র সরকারি ঘোষণা হয়েছিলো ২০১২-র ১৭ই ফেব্রুয়ারি। ২০১৪-র ডিসেম্বরে কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়। কমিশন সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কিন্তু যিনি সেই ‘অভিযান’-র উদ্যোক্তা, সেই মমতা ব্যানার্জিকে কমিশন ডাকেনি। কমিশন কেমন কাজ করেছে, তা এ’ থেকে কিছুটা বোঝা যায়। তবু কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জি তাঁর তদন্ত রিপোর্ট জানাতে বাধ্য হয়েছেন, যে ১৩জনের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন, তাদের মধ্যে একজনের গায়ে গুলির কোনও আঘাতই মেলেনি। সেই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ ‘সিরোসিস অব লিভার’। সাধারণত এই রোগটি বেপরোয়া মদ্যপানের কারণে হয়। আর বেপরোয়া মদ্যপান দুষ্কৃতীদের পরিচিত বৈশিষ্ট্য।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব তখন ছিলেন মণীশ গুপ্ত। এখন তিনি রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রসচিব হিসাবে তিনি সেদিনের ঘটনার বিষয়ে হাইকোর্টে একটি হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। ১৯৯৩-র ২রা আগস্ট তাঁর জমা দেওয়া সেই হলফনামা অনুসারে, ওই দিন(১৯৯৩-র ২১শে জুলাই)-এ জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুষ্কৃতী(অ্যান্টিসোস্যাল) নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জড়ো হয়েছিলো। ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাজ্যের কয়েক হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং ব্রেবোর্ন রোডে জমায়েত হয়। মেয়ো রোডে ১৫ হাজার, ধর্মতলায় ১৫ হাজার, ব্রেবোর্ন রোডে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১০ হাজার, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ৭ হাজার জমায়েত ছিলো। যুব কংগ্রেস কর্মীরা মহাকরণের দিকে ছুটতে থাকে। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ‘জনতা’ পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোঁড়া হয় যথেচ্ছ। পুলিশ তখন লাঠি চালায়। ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটায় পুলিশ এবং রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি চালানো হয়।
অর্থাৎ সেদিন ‘আন্দোলনকারীরা’ বোমা, পাইপগান নিয়ে এসেছিলো! তারা মহাকরণ দখল করতে ছুটছিলো। গুলি ছুঁড়ছিলো, বোমা মারছিলো।
মণীশ গুপ্তর হলফনামা আরও জানিয়েছিল, সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিলো। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিলো। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডি সি (সদর), ৭জন ডি সি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিলো। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিলো। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর এ কে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিলো দুর্বৃত্তরা।
আক্রান্ত, রক্তাক্ত হয়েছিলো পুলিশ। তাই গুলি চালিয়েছিলো।
সেদিনও সাংবাদিক পিটিয়েছিলো মমতা ব্যানার্জির দলবল, হুবহু আজকের মতো। দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ ধর্মতলায় স্কুটার আরোহী ওই সাংবাদিক, সঈদ আহ্‌মেদকে মমতা ব্যানার্জির কর্মীরা ঘিরে ধরে মেরেছিলো। মারাত্মক আহত হন তিনি।
আরও কী চক্রান্ত ছিল? সোনালি গুহর কথাই শোনা যাক। সাতগাছিয়ার বিধায়ক সোনালি গুহ এখন রাজ্য বিধানসভার উপাধ্যক্ষা। ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাইয়ের স্মৃতিচারণা করতে তৃণমূলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’-য় একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি ২০১২-তে। সোনালি গুহ দলীয় মুখপত্রের (বর্ষ -৮,সংখ্যা ৩৯০, সাপ্তাহিক) সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন,‘‘১৯বছর আগের ২১শে জুলাই। দিনটি ছিল বুধবার। সকাল-সকাল আমরা দিদির বাড়ি চলে এসেছিলাম। আগে থেকেই আমাদের কয়েকজন মেয়েকে গোপনে একটা দায়িত্ব দেওয়া ছিলো।’’ কী সেই দায়িত্ব? বিধানসভার উপাধ্যক্ষা লিখছেন,‘‘তা হলো, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে দিতে হবে। আমরা তাই সটান চলে গেলাম রেড রোডে। কারণ ওই রাস্তা দিয়ে জ্যোতি বসুর কনভয় যাবে। মুসলিম মহিলাদের মতো বোরখা পরে সেদিন ওই রাস্তায় গিয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু শ্যামলী ভদ্র (প্রয়াত প্রাক্তন কাউন্সিলর)-র হাতের শাঁখা-পলা বেরিয়ে পড়ায় পুলিশ ধরে ফেলে।’’
পুলিশ সেদিন তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু যা স্পষ্ট, তা হলো — ১৯৯৩সালের ২১শে জুলাই মহানগরের ফাঁকা রাস্তায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকানোর চক্রান্ত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারজন্য রীতিমতো আগে থেকে ছক কষা হয়েছিলো। এমনকি ছদ্মবেশেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তা আজকের মতো আঁটোসাঁটো, কড়া ছিলো না। রাজ্যস্তরে ‘ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডো’ কথাটির অস্তিত্বই ছিলো না। ছিলো না এ কে ৪৭হাতে নিরাপত্তাকর্মী। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ছিল ছোট। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, কমরেড জ্যোতি বসুকে ঘিরে নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট শিথিল। সেই সুযোগে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি আটকে ঠিক কী করার ভাবনা ছিলো মমতা ব্যানার্জির— তা স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে গেছেন সোনালি গুহ। তবে বলাবাহুল্য, জ্যোতি বসুর গাড়ি আটকে তাঁকে নেহাতই প্রণাম করা, শুভেচ্ছা জানানোর বাসনা নিশ্চই ছিলো না তাঁদের। যদি শুধু বিক্ষোভ দেখানোর ইচ্ছাও থাকতো, তাহলে ছদ্মবেশ নেওয়ারও কোনো দরকার পড়তো না। এখানেই দানা বাঁধে সন্দেহ।

No comments:

Post a Comment